Magic Lanthon

               

কাওসার বকুল

প্রকাশিত ২৬ মার্চ ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

’৭৪ আর ’১৫-তে তফাৎ নাইরে ভাই

রাষ্ট্র নিয়ে বুনুয়েলের ফ্যান্টাসি

কাওসার বকুল


তারকোভস্কির গণতান্ত্রিক চলচ্চিত্রের পথ ধরে

সোভিয়েত রাশিয়ার বিখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা আন্দ্রেই তারকোভস্কির পছন্দের তালিকায় নির্মাতা হিসেবে লুই বুনুয়েল-এর নামটি ছিলো সবার আগে। তারকোভস্কি মনে করতেন, চলচ্চিত্র হবে গণতান্ত্রিক। যখন চলচ্চিত্রের বক্তব্য আর জনসাধারণের জ্ঞান একই স্তরে পৌঁছাবে, চলচ্চিত্র গণতান্ত্রিক হবে কেবল তখনই। তাই বলে গড়পড়তা সবার জন্য সাদামাটা চলচ্চিত্র-নির্মাণের কথাও তিনি বলেননি; বলেছেন মানব জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে গূঢ়ত্ব আনতে। যেটা নাকি তারকোভস্কি খুঁজে পেয়েছিলেন একমাত্র বুনুয়েলের চলচ্চিত্রেই। যেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তার বদলে ছিলো সামগ্রিকতা। যে কারণে ব্যক্তিগত সমস্যার বিপরীতে তার চলচ্চিত্রে বার বার উঠে এসেছে জাতিগত সমস্যা, সর্বোপরি মানুষের সমস্যা।

এই সমস্যা সমাধানে বুনুয়েল হাত দিয়েছেন একেবারে মূলে, মানে রাষ্ট্রে। বুনুয়েল তার চলচ্চিত্রে সবসময়ই উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন রাষ্ট্রের চরিত্রকে। তাই মুক্তির জন্য চলচ্চিত্র দিয়ে সবাইকে রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র চেনাতে চেয়েছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথাই ধরি; যুদ্ধে ক্ষতির পরিমাণ এতো ব্যাপক ছিলো যে, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এতদিনের গড়ে ওঠা সভ্যতা তখন ন্যুব্জ। পরিচিত দুনিয়ার অনেক কিছুই তখন আলগা, অপর মনে হতে থাকলো বুনুয়েল ও তার শিল্পী বন্ধুদের। তখন রোজকার সমাজটাকে মেনে নিতে তাদের কষ্ট হচ্ছিলো। বুকের মাঝখানটাতে কীসের একটা শূন্যতা পীড়া দিতে থাকতো প্রতিনিয়ত।

ধনতান্ত্রিক সভ্যতার সঙ্কটে আস্তে আস্তে জীবনটাকে যখন নিরর্থক মনে হতে শুরু করলো; তখন সমাজ-বাস্তবতা নিয়ে জমতে থাকা ক্ষোভ একপর্যায়ে ফুঁসে ওঠার উপক্রম হলো। ঠিক সেই সময়ে বাস্তবের আবরণকে দলিয়ে-মথিয়ে নতুন এক কাঠামো দেওয়ার সাধ জাগলো বুনুয়েল ও তার বন্ধুদের। একপর্যায়ে মনের ওপর থেকে যুক্তির স্বৈরাচারী শাসন ও সব রকমের অনুশাসন ঝেড়ে ফেলে নিজেদের ভিতরের মানুষটার কথা শোনার, সেই সত্তাকে উদ্ধারের চেষ্টায় তারা মেতে উঠলেন। যে ক্ষোভগুলোই বাষ্প হয়ে বেরিয়েছিলো চলচ্চিত্র হয়ে। পরাবাস্তববাদ ধারায় ধারাবাহিকভাবে সেই সময়ের সমাজ-বাস্তবতায় বুনুয়েল বিভিন্ন সময়ে নির্মাণ করেছেন এসব চলচ্চিত্র; দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টি (১৯৭৪) তন্মধ্যে অন্যতম। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ফ্রান্সের বাস্তবতায় নির্মিত দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টি বর্তমানে এসেও কতোটা যৌক্তিক, কিংবা এই ৪১ বছরে রাষ্ট্রের চরিত্র ঠিক কতোটা বদলেছে, সেটাই মিলিয়ে দেখার চেষ্টা থাকবে এই আলোচনায়।

পিঁপড়ার মিছিলের খোঁজে

মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বুনুয়েল যুক্ত হন স্প্যানিশ কবিদের দল লা জেনারেশন ডেল ২৭-এর (১৯২৩-১৯২৭) সঙ্গে। সালভাদর দালির সঙ্গে পরিচয় সেখানেই। অল্পদিনের মধ্যেই ভালো বন্ধুত্বও হয় দু-জনের মধ্যে। যদিও দুজনের মনোবৃত্তি ছিলো যথেষ্টই আলাদা; তার পরেও  তারা একত্রে বসলেই আলোচনা করতেন নতুন নতুন বিভিন্ন বিষয়ে। দালি ছিলেন স্বপ্নবান বাউণ্ডুলে এক তরুণ; অন্যদিকে বুনুয়েলের লক্ষ্য ছিলো আরো গভীর। সে কারণে দালি যখন পিঁপড়ার স্বপ্ন দেখে সেটার বর্ণনা দেন বুনুয়েলের কাছে, বুনুয়েল তখন জানতে চান¾সেই পিঁপড়েরা মিছিল করে কি না। শুধু সাদামাটা একটা স্বপ্ন নিয়ে টিকে থাকার বিপরীতে প্রতিরোধই ছিলো তার স্বপ্নের ভিত।

দালি ছাড়াও বুনুয়েলের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে দলটিতে থাকা কবি ফেডিরিকো গারছিয়া লরকাসহ সেসময়ের কিছু তরুণের, যারা ছিলো খুবই উদ্যমী। আঁভগার্দ আন্দোলনের বিভিন্ন শিল্পতত্ত্বের সঙ্গে এখানেই বুনুয়েলের জানাশোনা শুরু হয়। এ সময়ে সমাজের চলতি রীতি ভেঙে নতুন শিল্প সৃষ্টির তাড়না দেখা দেয় কিছু মানুষের মধ্যে; যে শিল্পরীতিকে ডাকা হয় আঁভগার্দ নামে। যার প্রথম দিককার রীতি বা ধারা হলো পরাবাস্তববাদ বা সুররিয়ালিজম। ২০-এর দশকে এর শুরুর কাজটি করেন ফ্রান্সের আঁদ্রে ব্রেতো। মনের অযৌক্তিক স্বপ্ন, সত্য, গোপন কল্পনা, ইমেজের আবেগ, ব্যক্তিগত কামনা বা যৌনতা প্রভৃতিই পরাবাস্তববাদের স্বাভাবিক লক্ষণ। শিল্প আন্দোলনগুলোর মধ্যে এটি ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা পর্যায়; যা এসেছিলো মূলত দাদাইজম, ফিউচারিজম আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।

অবশ্য পরাবাস্তববাদকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েডের অবদানও কম নয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে অবচেতন মনের ধারণা ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি যে আলোড়ন তৈরি করেছিলেন, তার প্রভাব পড়ে শিল্প চর্চাতেও। পরাবাস্তববাদীরাই সর্বপ্রথম এই ধারণাকে ব্যবহার করেন তাদের চলচ্চিত্রে। পরাবাস্তববাদের উদ্দেশ্য ছিলো দৃশ্যমান বাস্তবের আস্তরণ ছিন্ন করে অদৃশ্য বাস্তবকে তুলে ধরা; মানুষের অবচেতন মনের লুক্কায়িত সত্তাকে খুঁজে বের করা। মানুষের অবদমিত কামনা-বাসনাগুলোকে সব রকমের অবদমন থেকে মুক্ত করা। এজন্য তারা জোর দিয়েছিলেন তিনটি বিষয়ের প্রতি। মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, নানা বস্তুর সমন্বয় ঘটিয়ে দ্বান্দ্বিক কোলাজ তৈরি, আর অবচেতন মন ও স্বপ্ন সম্পর্কে সচেতন থেকে অলীক নির্মাণ। মূলত এগুলোর সমন্বয়েই হয়ে ওঠে পরাবাস্তববাদ।

সেই ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের দিকেই লা জেনারেশন ডেল ২৭-এ থাকা অবস্থায়ই আঁভগার্দের পাশাপাশি পরাবাস্তববাদ সম্পর্কেও জানাশোনা তৈরি হয় বুনুয়েলের। সে কারণে দালি যখন গল্পের ফাঁকে পিঁপড়াকে নিয়ে নিজের দেখা স্বপ্নের কথা বলেন, বুনুয়েল সেই স্বপ্নকে ঘিরেই চলচ্চিত্র নির্মাণের ঝুঁকি নিতে চান। ‘সাদামাটা’ এ রকম বিষয়কে ঘিরে নির্মাণও করেন আশিয়ান আন্দালু (১৯২৯)। নিজের জীবনের চলার পথ মসৃণ না হলেও দালির সহায়তায় বুনুয়েল কিন্তু ঠিকই চলচ্চিত্রে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। শিল্পতত্ত্বের সেই পরাবাস্তবকে চলচ্চিত্রে সর্বপ্রথম তুলে ধরেছেন তিনিই। মাত্র ১৬ মিনিটের আশিয়ান আন্দালু তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।

সেই ছোটোবেলা থেকেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটোছুটি, স্কুলের কঠোর নিয়ম, ক্যাথলিক চার্চের একঘেয়েমি তাকে বিষিয়ে তুলেছিলো। পরিণত বয়সে এসে শিল্পের প্রতি মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সেই আগুনে ঘি ঢালতে থাকে। তার পরেও তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে থাকেন মানুষের জন্য। যেখানে শোষিতদের জন্য বলা কথাগুলো পরাবাস্তবতার আশ্রয়ে হয়ে ওঠে ক্ষুরধার অস্ত্র। কিন্তু সেই চলচ্চিত্র আর সবার কাছে পৌঁছাতে পারতো না। রাষ্ট্র সেই চলচ্চিত্রগুলোকে শিল্প হিসেবে কখনোই দেখেনি। এর বিপরীতে চলে নানাভাবে এগুলোকে আড়ালে রাখার চেষ্টা। রাষ্ট্রের এই আচরণ মেনে নিতে পারেননি বুনুয়েল। জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও তার চলচ্চিত্রে তাই উঠে এসেছে রাষ্ট্রের অনিয়ম-দুর্নীতির কথা; সর্বোপরি বুনুয়েলের চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রের দর্পণ। কেবল বাস্তবের উপস্থাপন করেই ক্ষান্ত হননি তিনি। বাস্তবের আস্তরণ ভেঙে নতুনভাবে সাজানোর জন্য কঠোর আঘাতও হেনেছেন। জীবনের তিক্ত বিরক্তিতে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে এসে নির্মাণ করা দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টিও তাই হয়ে উঠেছে তৎকালীন সমাজ-বাস্তবতার দর্পণ।

যেনো খেলার ম্যাজিক বক্স

১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে টলিডো শহরে নেপোলিয়ানের সৈন্যরা যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো, ফ্রান্সিসকো গয়া’র তুলির আঁচড়ে চাক্ষুস হয়ে উঠেছিলো সেই বীভৎসতা। ঘটনাটির গোছালো উপস্থাপন পাওয়া যায় স্প্যানিশ রোমান্টিক কবি ও লেখক গুস্তাভো এ রিক্যুয়ার-এর ছোটোগল্প ‘দ্য কিস’-এ। গয়ার সেই বিখ্যাত চিত্রকর্ম ও ‘দ্য কিস’ থেকে ভীষণ অনুপ্রাণিত হন বুনুয়েল। সেই ভালোলাগা থেকে দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টির প্রথম শটেই জুড়ে দেন গয়ার বিখ্যাত সেই চিত্রকর্মটি। পরের শটেই স্পেনের বিদ্রোহী কয়েকজনকে লাথি মারতে মারতে নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে আসে নেপোলিয়ানের সৈন্যরা। যেখানে বিদ্রোহীরা স্লোগান দিতে থাকে, ‘বন্দিরা মুক্তি পাক, নেপোলিয়ান নিপাত যাক’ (Long live chains, Death to the gabachos)। একপর্যায়ে তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর পরই ক্যাথলিক চার্চে নেপোলিয়ানের বাহিনী মত্ত হয়ে ওঠে মদ্যপান, নাচ-গান আর খাওয়া-দাওয়ায়।

নেপোলিয়ান বাহিনীর মদ্যপ ক্যাপ্টেন একপর্যায়ে চার্চের মধ্যে থাকা এক নারীমূর্তিকে আলিঙ্গনের চেষ্টা করলে, তার মাথায় হাত দিয়ে আঘাত করে মূর্তিটির পাশে রাখা পাথুরে স্বামী; এতে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। অথচ খানিকবাদেই দেখা যায়, কফিন খুলে ওই নারীমূর্তিটির মৃতদেহ দেখছে সেই ক্যাপ্টেন। আর এখানেই বুনুয়েল হাজির হন পরাবাস্তব শিল্পী হয়ে। এরপর ম্যাজিক বক্সের মতো চলচ্চিত্রের কাহিনি ঘুরতে থাকে এ-হাত থেকে অন্য হাতে। কাহিনি কোন জায়গা থেকে কোথায় যাচ্ছে ভালোভাবে খেয়াল না করলে দর্শক খেই হারিয়ে ফেলবে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

চলচ্চিত্রের এই পর্যায়ে এসে দেখা যায়¾এতক্ষণের যে দৃশ্যকল্প, পার্কে বসে সেই গল্পটা পড়ছে এক গৃহপরিচারিকা। যিনি হেনরি নামের এক কিশোরীকে বেড়াতে নিয়ে এসেছেন পার্কে। ম্যাজিক বক্স এবার হেনরির হাতে। হেনরির সঙ্গে তাদের বাসায় এগিয়ে যায় চলচ্চিত্রের কাহিনি। পার্ক থেকে বাসায় ফিরেই মায়ের হাতে কয়েকটা আলোকচিত্র তুলে দেয় হেনরি। আলোকচিত্রগুলো দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়েন মা; হেনরিকে শাসিয়ে গৃহপরিচারিকাকে বিদায় করে দেন তিনি। মেয়েকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না হেনরির বাবা। ঘুমের মধ্যে তার ঘরে একে একে আসতে থাকে মুরগি, ডাকপিয়ন, উটপাখি। বিপাকে পড়ে উদ্ভট এসব সমস্যা নিয়ে পরদিন মানসিক চিকিৎসকের চেম্বারে যান তিনি। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে সেখানকার এক সেবিকা উপস্থিত হন। যিনি অসুস্থ বাবাকে দেখার জন্য জরুরিভাবে বাসায় রওনা দেওয়ার অনুমতি নিতে এসেছেন। ম্যাজিক বক্স এবার এগোতে থাকে সেবিকাকে নিয়ে। পথিমধ্যে সেবিকার সঙ্গে দেখা হয় কামানবাহী গাড়ি নিয়ে পাহারারত একদল সেনার, যারা রাস্তায় শেয়াল খুঁজছিলো। রাত হওয়ায় ওই সেবিকা ওঠেন এক হোটেলে।

হোটেলে সেবিকার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় কয়েকজন যাজক, ফুফুকে নিয়ে বেড়াতে আসা এক যুবক, টুপিনির্মাতা ও তার নারী সহযোগীর। সেবিকার বাবা অসুস্থ জেনে যাজকরা রাতে তার জন্য প্রার্থনা করে; এরপর তার ঘরেই শুরু হয় তাস খেলা, ধূমপান ও মদ্যপান। পাশের এক ঘরের দরজা খোলা রেখেই উদ্ভটভাবে নাচতে দেখা যায় এক নারীকে। আরেক ঘরে ফুফুকে বিবস্ত্র দেখার জন্য জোরাজুরি করতে থাকে সেই যুবক। নিরুপায় হয়ে একপর্যায়ে যখন নগ্ন হন বয়স্ক ওই নারী; তাকে দেখা যায় তরুণীর অবয়বে। এদিকে টুপিনির্মাতা আড্ডা দেওয়ার কথা বলে অন্যদের একে একে নিজের ঘরে আনলেও, কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে চাবুক মারতে থাকে তার নারী সহযোগী।

পরদিন বাসায় ফেরার পথে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে এক অধ্যাপককে লিফট্ দেন ওই সেবিকা। ম্যাজিক বক্স এবার ঘুরতে থাকে অধ্যাপকের সঙ্গে। অধ্যাপক ক্লাস নিতে থাকেন সৈনিকদের, একপর্যায়ে তার অনুমতি ছাড়াই একে একে সৈনিকদের ডেকে নিতে দেখা যায়। তার পরও অধ্যাপক ক্লাস চালাতে থাকেন। শিক্ষার্থীদের একটা বিষয় বোঝানোর জন্য নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে চলে যান ফ্ল্যাশব্যাকে। সেখানে দেখা যায়, একটা ডাইনিং টেবিলের চারপাশে চেয়ারের বদলে পেতে রাখা হয়েছে কমোড। সবাই একসঙ্গে সেখানে টয়লেট সারছে। চুপি চুপি দুই-এক জন সেখান থেকে উঠে গিয়ে টয়লেটের মতো ছোটো ঘরে গোপনে খাবার খাচ্ছে।

ম্যাজিক বক্স আবার হাতবদল করে। ক্লাস শেষে সেখানকার এক সেনাসদস্য চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে যান। চিকিৎসক তাকে জানান, ক্যান্সার হয়েছে, একই সঙ্গে তাকে সিগারেটও অফার করেন। এতে বিরক্ত হয়ে চিকিৎসককে চড় মেরে সেখান থেকে বাসায় চলে যান তিনি। এরপর স্কুল থেকে ফোন করে সেই সৈনিকের স্ত্রীকে জানানো হয়, তাদের মেয়ে হারিয়ে গেছে। হন্তদন্ত হয়ে ওই দম্পতি স্কুলে গিয়ে দেখতে পান তাদের মেয়ে স্কুলে বহাল তবিয়তেই আছে। এর পর সেই মেয়েশিশুটিকে নিয়ে চলতে থাকে নানা ঘটনা। স্কুল থেকে ডায়েরি করতে বলা হলে, মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে থানায় নিখোঁজের ডায়েরি করতে যান ওই দম্পতি। থানার সবাই এমন আচরণ করতে থাকে, যেনো সত্যিই শিশুটি হারিয়ে গেছে। মামলা নেওয়ার পর সেই শিশুটিকে খোঁজার দায়িত্ব পড়ে এক পুলিশ কর্মকর্তার ওপর। ওই কর্মকর্তা শিশুটিকে খোঁজার নামে বহুতল ভবনে উঠে ইচ্ছেমতো পথচারীদের গুলি করে হত্যা করতে থাকে। একপর্যায়ে তিনি গ্রেফতার হন। পরে আইনের বিভিন্ন ধারা দেখিয়ে আদালত তাকে বেকসুর খালাস দেন। আর ওই বাচ্চাকে তার বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেন পুলিশের এক কমিশনার।

এবার ম্যাজিক বক্স চলে আসে কমিশনারের হাতে। কমিশনার তার চেয়ারে সহকারীকে বসিয়ে জরুরি কাজের কথা বলে চলে যান একটি বারে। সেখানে এক নারীর সঙ্গে গল্পের একপর্যায়ে, চার বছর আগে তার বোনের মৃত্যুর কথা বলেন, যিনি দেখতে হুবহু ওই নারীর মতো। অথচ খানিক বাদেই সেই বোন ফোন করে তার সঙ্গে দেখা করার কথা বলে। পরে এক রাতে বোনের কফিনের পাশে ঝুলন্ত টেলিফোন এবং মাথার চুল কফিনের বাইরে বেরিয়ে থাকতে দেখা যায়। এ সময় কয়েকজন পুলিশ পরিচয়ে তাকে গ্রেফতার করে। চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে আবার শোনা যায়, ‘বন্দিরা মুুক্তি পাক, নেপোলিয়ান নিপাত যাক’। অন্যদিকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার নির্দেশের পর কেবল শোনা যায় গুলির শব্দ; পর্দা পড়ে দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টির।

‘গোপনও কথাটি রবে না গোপনে’

কল্যাণ কিংবা জনকল্যাণের কথা বলে ব্যক্তি, পরিবার থেকে রাষ্ট্র¾সবাই; কখনো প্রথা, কখনো মূল্যবোধ আবার কখনো আইন করে অনেক কিছুকে গোপন রাখতে চায়। যে কারণে এই তথ্য পাওয়ার জন্য আবার রাষ্ট্রেরই আইন প্রণয়নের প্রয়োজন পড়ে। কারণ, অনেক তথ্যই প্রকাশ হয়ে গেলে রাষ্ট্রের কর্তাদের গায়ে আঁচ লাগবে। সে কারণেই তথ্য গোপন রাখার প্রশ্নটি ‘জাতীয় স্বার্থ’ কিংবা ‘সার্বভৌমত্ব রক্ষা’র বিষয় হয়ে ওঠে। এই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জ্ঞান উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কথাই ধরুন। পরীক্ষা কমিটির সভাপতি কে প্রশ্ন করবেন, উত্তরপত্র কে মূল্যায়ন করবেন, কোন শিক্ষক কোন শিক্ষার্থীকে কতো নম্বর দিবেন, কিংবা কোন শিক্ষক তার কোর্সের নম্বর জমা না দেওয়ার কারণে রেজাল্ট আটকে আছে, এর সবই গোপন রাখা হয়। এই গোপন রাখা কার স্বার্থে?

একদিকে চলে তথ্য গোপন রাখার চেষ্টা, অন্যদিকে চলে অন্যের গোপন বিষয়ে আড়ি পাতার ঘটনা। ফোন থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় চলে নজরদারি, আড়ি পাতা। এতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কোনো ব্যক্তির ফোনালাপ যেমন ফাঁস হয়ে যায়; ফেইসবুকে কোনো অ্যাপ ব্যবহার করে ফলাফল জানার সময় কর্তৃপক্ষ জেনে যায় সেই গ্রাহকের সব কর্মকাণ্ডই। অথচ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ আড়ি পেতে রাঘব বোয়ালদের তথ্য জেনে সেটা যখন ফাঁস করে দেন; গণতন্ত্র, উদারতার বুলিতে গলা ফাটানো আমেরিকাও তার বিরোধিতা করে। আবার সেই আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এন এস এ) অন্যের গোপন বিষয়ে দিনের পর দিন আড়ি পেতেছে। আড়ি পাতার সেই তথ্য ফাঁস হলে নিজেদের ইমেজ রক্ষার তাগিদে গণতন্ত্রের ধুয়া তুলে, মুক্ততার কথা বলে ‘গোপন নজরদারি আদালতের’ অনেক তথ্য প্রকাশের সিদ্ধান্তও নিয়েছে তারা। তথ্য প্রকাশের এই আনুষ্ঠানিকতা যতোটা না মানুষকে তথ্য জানানোর, তার চেয়ে বেশি রাষ্ট্রীয় ইমেজ রক্ষার স্বার্থে। তাছাড়া যে তথ্যগুলো জানানো হচ্ছে, সেগুলোইবা কতোটা কাজের¾প্রশ্ন আছে সেটা নিয়েও।

এগুলোর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র আসলে তার যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে জায়েজ করে নেয়। যেমনভাবে ক্রসফায়ার জায়েজ করে নেয় বাড়ি গিয়ে আসামি ধরার মধ্য দিয়ে, আর মুক্ততার কথা বলে গোপন রাখার বিষয়টিও। পরিচয় গোপন রাখার কথা বলে সাধারণের গোপনীয় বিষয়ে তথ্য নেওয়া হয়, অথচ তার ফলাফল প্রকাশ করা হয় উন্মুক্তভাবে। পরবর্তী সময়ে আবার শোষক শ্রেণি, ওই মানুষগুলো সম্পর্কে ধারণা পোষণ করে সেই তথ্যগুলোর ভিত্তিতেই। তাহলে মুক্ততার কথা বললেও গোপন রাখাই কি রাষ্ট্রের চরিত্র? যেমনটা চলছে এখন গণতন্ত্রের নামে। সমাজের তৈরি করা এ রকম দ্বৈত আচরণগুলো নিয়ে দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টিতে খেলেছেন বুনুয়েল।

ক. ফ্যান্টাসি-১

আগেই বলেছি, পার্কে এক ভদ্রলোক হেনরিকে কয়েকটি আলোকচিত্র দিয়েছিলো। বাসায় ফিরে সেগুলো দেখে হেনরিকে তার মায়ের শাসানো কিংবা গৃহপরিচারিকাকে বিদায় করে দেওয়ার কারণ খুঁজলে কেবল একটা বিষয়ই মাথায় আসে; আলোকচিত্রগুলো নিশ্চয় ‘অশ্লীল’, পর্নোছবি। কিন্তু সেটাতো হয়নি। মজার ব্যাপার হলো, হেনরির বাবা এই আলোকচিত্রগুলোর একটি তার স্ত্রীকেও দেখাতে রাজি নন। তার যুক্তি, সেই আলোকচিত্রটা একেবারেই বাজে। হেনরির মা আলোকচিত্রটা দেখতে চাইলে তিনি শেষ পর্যন্ত তা ছিঁড়ে ফেলেন। পরে দেখা গেলো সেটা একটি গির্জার ছবি। আলোকচিত্রের ছেঁড়া টুকরোগুলো পাশাপাশি জোড়া লাগিয়ে দেখার পর হেনরির মাও তার স্বামীর কথায় সায় দেন। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, দর্শনীয় স্থানের ছবি নিয়ে যারা এতো চিন্তিত, তাদের ঘরেই রাখা আছে নগ্নমূর্তি। হেনরির বাবা-মা যে ঘরে বসে আলোকচিত্রগুলো দেখছিলেন সেখানেই এক টেবিলের উপর রাখা আছে সেই মূর্তিটি। আলোকচিত্রগুলো দেখা থেকে শুরু করে, গৃহপরিচারিকাকে বিদায় দেওয়া¾সবই ঘটে নগ্ন সেই মূর্তিটির পাশে দাঁড়িয়েই।

তাছাড়া, হেনরিকে দর্শনীয় স্থানের ছবি দেখতে না দিলেও, হেনরির আঁকা মাকড়সার চিত্রের প্রশংসা করে তার বাবা। তার মানে ‘অস্বাভাবিক’ কিংবা ‘স্বাভাবিক’ আরোপিত একটা বিষয়। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যুক্তরাজ্যের হার্টফোর্ডশায়ার রাজ্যের স্পিলপ্লাজ গ্রাম, যেখানে কেউ পোশাকই গায়ে জড়ায় না। সেই গ্রামের লোকেরা কাপড় পরা কারো কাছে কোনো রকম লেনদেন তো করেই না, গ্রামে ঢুকতে পর্যন্ত দেয় না বিবস্ত্র না হওয়া অবধি। ‘সভ্য’ না হয়ে উঠার কারণে সেখানকার মানুষ এ রকম করছে, বিষয়টা সেরকমও নয়। ঔষধ সেবন থেকে শুরু করে তারা আধুনিক সব যন্ত্রপাতিও ব্যবহার করে; শুধু পোশাকটাই পরে না। নগ্নতার মধ্যে তারা অসভ্যতার কিছু দেখে না। পোশাকে আবৃত ‘সভ্য’ সমাজে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও, নগ্ন হয়ে থাকার পরও আজ পর্যন্ত স্পিলপ্লাজে কেউ ধর্ষিত হয়নি।

কাপড় না পরার সমস্যা সেখানেই, যেখানে কিছু মানুষ কাপড় পরে। সে কারণেই কাপড় পরা হয়ে উঠে স্বাভাবিক আর নগ্ন থাকা হয় অস্বাভাবিক। যে ধারণা থেকে প্রতিনিয়ত ফায়দা লুটে একটা পক্ষ। চোখের সামনে এ রকম শোষণ মেনে নিতে পারেননি বুনুয়েল। যে কারণে তার প্রতিবাদের ভাষা পরাবাস্তববাদ ধারায় দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টি হয়ে উঠেছে এক অদ্ভুত প্রতিবাদ। বুনুয়েল সেখানে ঢেকে রাখার রাজনীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে পরাবাস্তবতার আশ্রয় নিয়েছেন।

তাছাড়া, ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের বাস্তবতায় ফ্রান্সে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে কোনো রকম পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো না। স্রষ্টা তার মতো করে শিল্প সৃষ্টি করতেন, কিন্তু সাধারণের কাছে সেই বিষয় অনেকাংশেই থেকে যেতো অজানা। কিন্তু শিল্পের তো কোনো দেশ, গণ্ডি নেই; নেই কোনো সীমানা প্রাচীরও। মানবতা, বাস্তবতা, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে শিল্পকে সবার কাছে পৌঁছাবার পথ সুগম করে দিতে হবে। বুনুয়েলের উদ্দেশ্য ছিলো মুক্ত সৃজনশীল চিন্তার পথের সব প্রতিবন্ধকতাকে সরিয়ে ফেলে বহুচেনা বাস্তব ও তার যুক্তিনির্ভরতাকে বৈপরীত্য দিয়ে পুনঃনির্মাণ করার। সেই ইচ্ছা থেকেই হয়তো এ রকম দৃশ্যের অবতারণা করেছেন তিনি। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন শিল্পীর সৃজনশীল সব শিল্পকর্ম ছড়িয়ে পড়–ক সবার মধ্যে; শিল্প হয়ে উঠুক গণতান্ত্রিক।

খ. ফ্যান্টাসি-২

ঘটনার এ রকম উল্টো উপস্থাপনও দেখা যায় আরেকটি দৃশ্যে। ডাইনিং টেবিলের চারপাশে চেয়ারের বদলে পাতা আছে কমোড। সেখানে একসঙ্গে টয়লেট সারছে কয়েকজন। পত্রিকা পড়ার ফাঁকে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তাও হচ্ছে সেখানে। এ সময় ছোটো এক মেয়ে তার মায়ের কাছে নিজের ক্ষুধা পাওয়ার কথা জানালে, মা তাকে চুপ করতে বলে এবং টয়লেটে বসে ক্ষুধা পাওয়ার কথা ভবিষ্যতে কখনো না বলার জন্য সতর্কও করে দেন।

সেনাবাহিনীর ওই অধ্যাপক এ সময় চুপিসারে সেখান থেকে উঠে ছোটো এক ঘরে (টয়লেটের মতো) ঢুকে যান। এরপর দরজার সিটকিনি আটকে সুইচ চেপে দেয়ালের ভিতরে রাখা খাবার বের করেন। পরে সাড়াশব্দহীনভাবে সেগুলো খেতে থাকেন। হঠাৎ একজন টোকা দেয় সেই ঘরের দরজায়; ভিতরে একজন খাচ্ছে জানতে পেরে টোকা মারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে চলে যান তিনি।

যে মানুষগুলো একসঙ্গে বসে টয়লেট সারছে, তারাই কিনা খাবার খাচ্ছে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করে! এমন দৃশ্য আমজনতার মস্তিষ্কে হুইসেল বাজিয়ে যায়; চিরচেনা বাস্তবের পৃথিবী সম্পর্কে খটকা তৈরি করে। রাষ্ট্র, ধর্মের বিরুদ্ধে, সর্বোপরি যাবতীয় চিরায়ত মূল্যবোধকে সরাসরি আঘাত করে এই দৃশ্য। আসলে মনের ওপর থেকে যুক্তির স্বৈরাচারী শাসনকে সরিয়ে ফেলে মনের ভিতরে লুক্কায়িত সত্তার কথা শোনার জন্য শিশুর পৃথিবীতে, উন্মাদনার জগতে ফিরে গেছেন বুনুয়েল। এই দৃশ্যে যে অপ্রত্যক্ষ বাস্তবতা ফুটে উঠেছে, তা যেনো লুকিয়ে আছে প্রত্যেকটা মানুষেরই মনে, আমাদের অবচেতনে, কল্পনায়, মায়া ও অযৌক্তিক আচরণের মধ্যে। যে কারণে বুনুয়েলের চলচ্চিত্রে ডাইনিং টেবিলে চেয়ারের পরিবর্তে পাতা থাকে কমোড। প্রথাগত শিল্পের বদলে এ রকম নৈরাজ্যবাদী চিন্তা আসলে প্রবলভাবে স্বাধীন থাকার আকাক্সক্ষা; দর্শকের স্বাধীন থাকার ইচ্ছাকেও অসীম করে তোলার ইচ্ছায়, শিল্পীর দায়বদ্ধতা থেকেই হয়তো বুনুয়েল এ রকম দৃশ্যের সংযোজন করেন।

এজন্যই আরেকটি দৃশ্যে পুলিশ কমিশনারের বোনকে দেখা যায় নগ্ন অবস্থায় পিয়ানো বাজাতে। ভাই সেখানে সঙ্কোচহীনভাবে ঘোরাফেরা করে। নগ্নতার কারণে কোনো রকম আচরণগত সঙ্কট সেখানে দেখা যায় না। তাছাড়া আরেকটি ব্যাপারও ঘটে, যেটা হেনরিকে ছবি দেওয়ার বিষয়ের সঙ্গে মিলে যায়। মিষ্টি একটা সুরে বোন পিয়ানো বাজাতে থাকলেও, কমিশনার সেটাকে ভালো না লাগার কথা জানায়। এর পর তার পছন্দে বাজনা তুলতে বলেন বোনকে। এবারের উৎকট সুর কানে এসে বিঁধতে থাকে। কমিশনার সেই বাজনার তালে তালে হাত নাড়িয়ে বোঝাতে চাইছেন, ‘এইতো ঠিক আছে, এটাই তো চাচ্ছিলাম।’ খেয়াল করলে যুদ্ধের দামামা বাজার শব্দের সঙ্গে এই সুরের মিল পাওয়া যায়। বুনুয়েল এখানেও হাজির হন তার ফ্যান্টাসিসত্তা নিয়েই।

‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’

টুইন টাওয়ারে প্রায় তিন হাজার লোক মারা যাওয়ার আগে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ইরাকে পাঁচ লক্ষ শিশু মারা গিয়েছিলো। সেই শিশুদের নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কোনো রিপোর্টই করেনি, কেউ কথাও বলেনি। অথচ, টুইন টাওয়ারে মৃতদের নিয়ে এতো কথা বলা হয়েছে, যা আর কোনো ক্ষেত্রে বলা হয়নি, হয়তো হবেও না। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সব মৃত্যু এক হলেও পরিস্থিতি ভেদে কোনো কোনো মৃত্যু অতি ‘মূল্যবান’, আবার বেশিরভাগ মৃত্যুই ভীষণ ‘মূল্যহীন’। কখনো কখনো পরিস্থিতি এমন হয় যে, ‘মূল্যবান’ দু-এক জনের মৃত্যুর জন্য অসংখ্য মৃত্যু অবধারিত হয়ে ওঠে। অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রান্সিস ফার্দিনান্দ নিহতের জের ধরে সংঘটিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তো সে কথাই বলে।

একই ঘটনা দেখি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টিতেও। চলচ্চিত্রটি নিয়ে আলোচনার আগে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে আমাদের দেশে ঠিক কী ঘটেছে, সেটা একটু দেখে নিই। ২০১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ১০৭ জনকে; পরে যাদের অনেকেরই মৃতদেহ পড়ে ছিলো বিভিন্ন স্থানে। একই পরিচয়ে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত ২৫ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়; যাদের মধ্যে থেকে মৃতদেহ পাওয়া গেছে মাত্র পাঁচ জনের। বাকিদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। গুম হয়ে যাওয়া এই মানুষগুলোর বেশিরভাগই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী। এরা যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, তাদের গুম হওয়া নিয়ে সেই দলও চোখে পড়ার মতো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কেবল নিখোঁজের জন্য হাহাকার করছে তাদের স্বজনেরা। দলের টনক নড়েছে তখন, যখন একজন বড়ো নেতা (সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব) গুম হয়েছেন। এই গুম তাদের এতটাই বিচলিত করেছে যে, শুধু তার জন্য হরতাল কর্মসূচিও (যদিও সে কর্মসূচিতে কৌশলে অন্যদের কথাও বলা হয়) দিয়েছে। আলাদা করে গণমাধ্যমেও এসেছে সেই নেতার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ। যদিও এর আগে নিখোঁজ হওয়া ২০ জনকে নিয়ে তা হয়নি। অথচ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাদেরও সমান গুরুত্ব পাওয়ার কথা। এমনকি এগুলো নিয়ে রাষ্ট্রেরও যে খুব একটা মাথাব্যথা আছে, তা কর্তাব্যক্তিদের আচরণে মনে হয়নি।

নিখোঁজ হওয়া সব পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উল্টোদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, তারাও নিখোঁজ ওই মানুষগুলোকে খুঁজছে। কিন্তু কোনোভাবেই নিখোঁজ সেই মানুষগুলোকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে দুটি ঘটনা ঘটতে পারে। হয় এই মানুষগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেই আছে। নিজেদের কাছে রেখেই তারা এই মানুষগুলোকে খুঁজে বেড়ানোর ভান করছে। অথবা পুলিশ পরিচয়ে অন্য কেউ তাদের তুলে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দায় এড়াতে পারে না। পুলিশ পরিচয়ে অন্য কেউ কাউকে তুলে নিয়ে গেলে, সেটা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব পুলিশেরই। অথচ দিনের পর দিন মানুষ গুম হয়েই যাচ্ছে, পুলিশ-প্রশাসন তার কিছুই করতে পারছে না। তার পরেও রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের বলতে শোনা যায়, নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে পেতে তারা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে!

বুনুয়েল এই বিষয়গুলোই দেখিয়েছেন ৪১ বছর আগে নির্মিত তার দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টিতে। এতদিন পর এসেও রাষ্ট্রের সেই চরিত্র খুব একটা বদলেছে কি? বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য ঘটনা আরেকটু এগিয়ে নিই। চলচ্চিত্রটিতে বাচ্চা না হারিয়েও দেখানো হয় বাচ্চা খোঁজার ঘটনা। মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার সংবাদে হন্তদন্ত হয়ে স্কুলে গিয়ে তাদের মেয়েকে বহাল তবিয়তে দেখেও তাকে খোঁজার ভান করে সেনা কর্মকর্তা ও তার স্ত্রী। মেয়ে বার বার তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তার কথায় পাত্তা না দিয়ে, তারা এমন আচরণ করতে থাকেন, মনে হয় সত্যিই সে হারিয়ে গেছে। একপর্যায়ে সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী শিক্ষিকাকে উদ্দেশ করে বলেন, এই স্কুলের প্রতি তার বিশ্বাস হারিয়ে গেছে। স্কুলটিতে তাদের মেয়েকে আর তারা রাখবেন না। এরপর মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গিয়ে নিখোঁজের ডায়েরি করলে, শুরু হয় বাচ্চা খোঁজার পালা। বাচ্চা ‘খুঁজে’ পেতে পুলিশের এক কর্মকর্তা বহুতল ভবনে উঠে গুলি করে ইচ্ছেমতো মানুষ মারতে থাকেন।

বাচ্চা খোঁজার নামে পুলিশ কর্মকর্তাকে দিয়ে নির্বিচারে মানুষ মারাটা নিরর্থক কোনো ঘটনা নয়। বর্তমানে গুম হওয়া মানুষকে খোঁজার নামে রাষ্ট্র যেগুলো করে, সেদিকে খেয়াল করলেই বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যাবে। বর্তমানে ‘অজ্ঞাত আসামি’ ও ৫৪ ধারায় যে কাউকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার ‘আইন’ আছে পুলিশের কাছে। কোনো একটা এলাকায় নাশকতা হলে, কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই চলে গণহারে ধরপাকড়। আটকের ভয়ে সেই এলাকার গ্রামের পর গ্রাম পুরুষ শূন্য থাকে। ‘আসামি’ ধরতে গিয়ে তাকে না পেয়ে বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়, শ্লীলতাহানি করা হয় নারীদের। যেমনভাবে দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টিতে বাচ্চা খুঁজতে গিয়ে তাকে না পেয়ে মানুষ মারা হয়।

চলচ্চিত্রটিতে নিখোঁজ না হওয়া শিশুর জন্য পুলিশ কর্মকর্তাকে দিয়ে গুলি করে মানুষ মারা, আর বর্তমানে নাশকতাকারীর তকমা তুলে গ্রামের পর গ্রাম পুরুষ শূন্য করার ঘটনা রাষ্ট্রের চরিত্রকেই তুলে ধরে। কোনো স্থানে পেট্রোলবোমা হামলা হলে, দুষ্কৃতিকারীকে নির্দিষ্টভাবে খুঁজে বের না করে পুলিশ যাকে-তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হয়রানি করে। হামলার জন্য আসলে কে দায়ী, সেই খোঁজ যেমন রাষ্ট্র করে না, পুলিশও না। তার বদলে পুলিশ ‘আইনি সহিংসতা’ করে। এর বিপরীতে ক্ষুব্ধ আরেকপক্ষ আবার বিভিন্ন স্থানে আগুন দেয়, ভাঙচুর করে। কিন্তু কেনো হামলা হয়, সেই প্রশ্নটা আর কেউ তোলে না। ফলে চলতে থাকে ঘটনার পুনরাবৃত্তি, চলতে থাকে সহিংসতা। তাহলে এই সহিংসতা টিকিয়ে রাখাই কি রাষ্ট্রের চরিত্র?

দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টিতে রাষ্ট্রের কোনো নাগরিককে খোঁজার জন্য ইচ্ছেমতো মানুষ মারার একপর্যায়ে গ্রেফতার হওয়া পুলিশ কর্মকর্তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন ‘আইনি’ ধারায়। কারণ এই কর্মকর্তা খুন করেছেন ‘রাষ্ট্রের প্রয়োজনে’। আজকের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও একই কথা বলে। গ্রামের পর গ্রাম মানুষকে ধরে নিয়ে যায়, ‘ক্রসফায়ার’ হয় ‘রাষ্ট্রের প্রয়োজনে’। ‘রাষ্ট্রের প্রয়োজন’ আরো পাকাপোক্ত হয় যখন খোদ রাষ্ট্রের কর্তা বলেন, ‘কঠিন ব্যবস্থা নিন, দায়িত্ব আমি নেব।’ সেজন্যই বুনুয়েলের চলচ্চিত্রে সেই গুলি করা পুলিশ কর্মকর্তা বেকসুর খালাস পাওয়ার পর চুরুট টানতে টানতে আদালত থেকে বেরিয়ে যান।

তাছাড়া গণমাধ্যম যেভাবে বিষয়গুলোকে উপস্থাপন করছে, তাতে করে সাধারণের পক্ষে বিকল্প চিন্তার জায়গা থাকে না। কেউ নিহত হলে গণমাধ্যমগুলো তাদের পরিচয় করিয়ে দেয় ‘নাশকতাকারী’, ‘বোমা হামলাকারী’, ‘অগ্নি সংযোগকারী’ নামে। সুতরাং মানুষ ভাবে, নিহত যে হয়েছে সে তো নাশকতাকারী; আর নাশকতাকারী মরলে কার কী এসে যায়! দেশের প্রথম সারির পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হয়, ‘গুলিবিদ্ধ ১৫-র ৯ জনই অরাজনৈতিক ব্যক্তি’৬। উল্টোভাবে তার মানে দাঁড়ায়, রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের গুলি করলে সমস্যা নেই! এই সংবাদ রাষ্ট্রের দেওয়া নাশকতাকারী, অবরোধকারী তকমাকে জায়েজ করে। এই চর্চা মৃত্যুকে সাধারণীকরণ করে তোলে। যা রাষ্ট্রের আইনি সহিংসতাকে সমর্থন দেয়। সে কারণেই হয়তো বুনুয়েলের চলচ্চিত্রে পাখির মতো গুলি করে মারা নিহতেরা কোনো বিচার পায় না।

দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টিতে যেখানে নির্বিচারে মানুষ হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে, সেখানেই কিনা সেনাবাহিনী পথে ট্যাঙ্ক নিয়ে বেরিয়েছে খেঁকশিয়াল খুঁজতে! এখনো বিশালাকার ট্যাঙ্ক, জলকামান নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে দেখা যায় ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী’দের। অথচ রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে একজন গুম হয়ে যায়, সেই মানুষের আর খোঁজ পাওয়া যায় না। পুলিশ, র‌্যাব সবাই বলে তারা গুম হয়ে যাওয়া লোকদের সম্পর্কে কিছু জানে না। শেষ পর্যন্তও এই  মানুষগুলোর কোনো খোঁজ দিতে পারে না খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কেবল তাদের বলতে শোনা যায়¾দুই স্তর, তিন স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা। অথচ তাদের নাকের ডগার উপর দিয়ে অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে ফেলে রেখে গেলেও কিংবা পহেলা বৈশাখের দিন ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করলেও পুলিশ কোনো রকমের পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। এজন্যই হয়তো বুনুয়েলের চলচ্চিত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব থাকে ট্যাঙ্ক নিয়ে খেঁকশিয়াল খুঁজে বেড়ানো।

কিন্তু যে বাচ্চা আছে জেনেও পুলিশ তাকে খুঁজে বেড়ায়, এতো মানুষ মেরে ফেলে তার জন্য; সেই বাচ্চা তো তারা খুঁজে পায় না! বাচ্চা খুঁজে পাবে কী করে, সে তো হারায়ইনি! তাহলে গুম হওয়া এই মানুষদের ক্ষেত্রেও কি একই ঘটনা ঘটছে?

বাঘ-বকরি খেলা, বকরি সাধারণ মানুষ

আর সব পাখি থেকে উটপাখির আলাদা দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, সব থেকে বড়ো হওয়া সত্ত্বেও উটপাখি উড়তে পারে না। আর দ্বিতীয়ত, কোনো রকম বিপদ দেখলে মাটিতে মাথা গুঁজে বিপদকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা। দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টিতে দুবার দেখা যায় এই উটপাখিকে। প্রথমবার, হেনরির বাবার স্বপ্নের মধ্যে; আর দ্বিতীয়বার চলচ্চিত্র শেষের আগ মুহূর্তে স্পেনের বিদ্রোহীরা যখন স্লোগান দিতে থাকে, ‘বন্দিরা মুুক্তি পাক, নেপোলিয়ান নিপাত যাক’, সেসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বিদ্রোহীদের ওপর গুলি চালালে পর্দায় ভেসে ওঠে উটপাখির অসহায় চাহনি।

কাদের ওপর গুলি চালানো হচ্ছে, সেটা চাক্ষুষ করা না গেলেও, বিদ্রোহীদের চিৎকার আর গুলির শব্দে বুঝতে কষ্ট হয় না, সেখানে ঠিক কী ঘটছে। ভীত-সন্ত্রস্ত উটপাখিকে দিয়ে আতঙ্কটাকে তুলে ধরেছেন বুনুয়েল। সেই সঙ্গে পরিষ্কার করেন, রাষ্ট্রের চোখে গুলি করে মারা এসব সাধারণ মানুষের অবস্থান। গুলি চালানোর আগে পুলিশের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তার কথোপকথন থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়।

১ম কর্মকর্তা : কী করবেন আজ সকালে?

২য় কর্মকর্তা : আপনি তো জানেনই আজ সকালে ...।

১ম কর্মকর্তা : ওহ, হ্যাঁ, চিড়িয়াখানায় ...।

২য় কর্মকর্তা : আমি একরকম প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছি।

১ম কর্মকর্তা : ১২ ভ্যান পুলিশ অবশ্য পাশেই রেখেছি।

২য় কর্মকর্তা : ওদের একসঙ্গে রাখা ঠিক হবে না। ছোটো ছোটো দলে বিভিন্নখানে রাখতে হবে; এখানে কয়জন, ওখানে কয়জন¾এভাবে।

১ম কর্মকর্তা : ওদের সতর্কতা সম্পর্কে তো আর আমরা জানি না। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওদের ঠেকাতে হবে।

২য় কর্মকর্তা : তালা ঠিক করে দেওয়া আছে কি না, সেটাও খুব ভালোভাবে দেখে নেওয়া আছে।

১ম কর্মকর্তা : কোনোভাবে যদি কিছু প্রাণী মারা যায় তাহলেই লাভ।

২য় কর্মকর্তা : আমাদের মানুষেরা জেব্রার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, কর্মকর্তা দুই জনের এ আলোচনা ঠিক কোন বিষয়ে। চিড়িয়াখানা বলতে মূলত স্পেনের বিদ্রোহীদের অবস্থানকে বোঝানো হয়েছে। আর জেব্রার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে বিদ্রোহীদের। উটপাখি এখানে অবতীর্ণ হয়েছে সাধারণ মানুষের প্রতীক হিসেবে। নিজেদের লোকজনকে এই কর্মকর্তারা মানুষ বলে মনে করলেও অন্যরা তাদের কাছে পশুর সমতুল্য। সে কারণেই মানুষের জন্য ‘জেব্রা’ মারতে তাদের একটুও বাধে না। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে হিসাবটা একটু মিলিয়ে দেখি, সেই পরিস্থিতি আজকের দিনে কতোটা বদলেছে।

২০১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে দেশের পরিস্থিতি দিনকে দিন কেবল খারাপের দিকেই যাচ্ছে। যদিও এই পরিস্থিতি আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। দীর্ঘ সময় ধরে এ রকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই পার হচ্ছি আমরা। হয়তো বর্তমানের চেয়ে আরো খারাপ অবস্থা ছিলো অতীতে। বিশেষ করে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনের পর এই পরিস্থিতি চরমে। সরকার ও বিরোধী দলের বাঘ-বকরি খেলায় বকরি হিসেবে ব্যবহৃত সাধারণ মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে।

কেবল ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে একশো ৭৬ জন, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ২৭ জন, সংঘর্ষে ৩২ জন নিহত এবং তিন হাজার ৫১ জন আহত হয়েছে। এছাড়া ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে একশো ২৩টি, যার মধ্যে ১৫ জনকে ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয়। ক্ষমতাসীন দল কেবল অগ্নিদগ্ধদের নিয়ে প্রশ্ন তুললেও বাকিদের ব্যাপারে কোনো কথা তোলেনি। অন্যদিকে বন্দুকযুদ্ধ, সংঘর্ষে নিহতদের লাশের হিসাব নিয়ে রাজনীতির মাঠ চষে বেড়ালেও আগুনে পুড়ে নিহতদের ব্যাপারে একইভাবে নিশ্চুপ আরেকটি দল। একপক্ষের হরতাল কর্মসূচি বর্জন করে যেমন সাধারণ মানুষ প্রমাণ করেছে তারা এসব চায় না। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষেও যে তারা নেই, ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতিতেই সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। তার পরেও দলগুলোর নেতৃস্থানীয়রা বলে বেড়ান, দেশের ১৬ কোটি মানুষ তাদের পক্ষে! দলগুলোর এসব কোন্দলে চলচ্চিত্রের জেব্রার মতো মারা পড়ছে সাধারণ মানুষ। যেগুলো থেকে ফায়দা লুটছে রাজনৈতিক দলগুলো।

সব মানুষ সমান হলেও, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মানুষ কেবল নিজের দলের লোকেরা। সে কারণেই বিরোধীদের গুলি করে, আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়; ধর্ষণ করা হয়, ভাঙচুর করা হয় বাড়িঘর। যেমনভাবে চলচ্চিত্রে গুলি করে মারা হয় ‘জেব্রা’। দলগুলোর এসব কোন্দলে প্রত্যেক দিন, প্রত্যেকটা মুহূর্তে আতঙ্কের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রতিনিয়ত যেখানে আগুনে পুড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে, গুলিবিদ্ধ হচ্ছে, গুম হয়ে যাচ্ছে; সেখানকার সবার অবশ্য আতঙ্কের মধ্যেই থাকার কথা। কোনোক্রমে নিজে এসব অঘটনের মধ্যে না পড়ে বেঁচে ফিরলে সে ভাবতেই পারে, ‘যাক বাবা, বেঁচে গেলাম।’ এ রকম একটা পরিস্থিতিতে উটপাখির মতো আতঙ্কিত হয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কীই-বা করার থাকে?

চলচ্চিত্রের শুরুতেই নেপোলিয়ানের সৈন্যদের হত্যাযজ্ঞের সময়ে বিদ্রোহীদের মুখে ‘বন্দিরা মুক্তি পাক, নেপোলিয়ান নিপাত যাক’ স্লোগান স্লোগান ছিলো; চলচ্চিত্রের শেষ মুহূর্তে গুলি করে মারা বিদ্রোহীদের মুখেও ধ্বনিত হয় সেই একই গান। ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ানের সৈন্য স্পেনের বিদ্রোহীদের যেমন কুকুর, বিড়ালের মতো মেরেছে; ১৯৭৪-এ এসে সেই ফ্রান্সে একইভাবে বিরোধীদের ওপর নিপীড়ন চালায় ক্ষমতাসীন ইন্ডিপেনডেন্ট রিপাবলিকান পার্টি। যার ধারাবাহিকতা এখনো লক্ষণীয়। আমাদের দেশেও বর্তমানে পেট্রোলবোমা দিয়ে পুড়িয়ে মারা থেকে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুম¾সব করছে কিন্তু স্বজাতির লোকেরাই। অনেকটা মাহমুদুজ্জামান বাবুর গান, ‘ভিনদেশি সেই বর্গীরা মা নেই তো এখন ঘরে, এখন দেখি সুজনের হাত বর্গী সেজে লুট করে’র মতো।

অনুশাসনের ওই লৌহ কপাট

ভেঙে ফেল কররে লোপাট

বেসরকারি এক আবাসিক স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। বিশ্ব-ইতিহাস পরীক্ষার দিন ঘটে একটা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। হোস্টেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক বিনা কারণে এক শিশুকে তিরস্কার করে। বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না শিশুটি। পরের দিন কাউকে না জানিয়েই বাড়ি ফিরে যায় সে; মাকে সাফ জানিয়ে দেয়, বিশ্ব-ইতিহাস পরীক্ষায় সে বহিষ্কার হয়েছে। শুধু তাই নয়, সিদ্ধান্ত নেয় সেই স্কুলে আর পড়তে না যাওয়ারও। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, যে বিশ্ব-ইতিহাস পরীক্ষা নিয়ে এতো কাণ্ড, ফল বেরোলে জানা গেলো¾ওই বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে শিশুটিই। ঘটনাটি লুই বুনুয়েলের নিজের।

নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এ রকম ঘটনার দ্বান্দ্বিক উপস্থাপন লক্ষ করি দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টিতে। সেনা কর্মকর্তাদের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের আচরণকে বুনুয়েল দেখিয়েছেন বাস্তবের যুক্তিনির্ভরতাকে পাশ কাটিয়ে বৈপরীত্যের মধ্য দিয়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ যেভাবে তাদের অধস্তনরা প্রশ্নাতীতভাবে পালন করে; তার বিপরীতে বুনুয়েল দেখালেন, একজন জেনারেলের ক্লাসে বিশৃঙ্খলভাবে সৈনিকদের ডেকে নিয়ে যাওয়া। এমনকি জেনারেলের কাছ থেকে এ সম্পর্কে কোনো অনুমতিরও প্রয়োজন লাগছে না! ওই শিক্ষক এতে এতোই বিরক্ত যে তিনি ঠিকমতো কোনো বিষয়ে আলোচনা করতেও পারছেন না। এতকিছুর পরও তিনি কোনো প্রতিবাদ করছেন না। শেষ পর্যন্ত টার্গেট প্র্যাকটিসের নামে সবাই চলে গেলে মাত্র দুজনের ক্লাসে নিরুপায় হয়ে লেকচার দিতে বাধ্য থাকেন তিনি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেইন অব কমান্ডের প্রতি অবজ্ঞা করেই এমন দৃশ্য দেখিয়েছেন বুনুয়েল। সেই সঙ্গে গৎবাঁধা নিয়মের পড়াশোনার প্রতিও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। যে কারণে ক্লাসে আইনের কিছু ধারা, সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে আলোচনা শুরু হলেও, কিছুক্ষণের মধ্যেই আলোচনার মোড় ঘুরে যায়। এর পর ওই শিক্ষক বলতে থাকেন, একটা মানুষ দিনে কী পরিমাণ মলত্যাগ করে, দুনিয়ার সব মানুষের মল একখানে করলে তার পরিমাণ কী হবে, এগুলো। শিক্ষার্থীদের দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সেগুলোই খাতায় লিখে রাখতেও দেখান বুনুয়েল।

কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয়; ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বুনুয়েল। সেই ছোটো বয়সে চার্চের যে কঠিন অনুশাসন, ক্ষমতা ও সম্পদের অপব্যবহার তিনি দেখেছিলেন, হোটেলের দৃশ্যে যাজকদের উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে হয়তো সেটাই তুলে ধরতে চেয়েছেন। বিজ্ঞান যেখানে কুসংস্কার ভেঙে নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে দিনকে দিন এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টির প্রধান যাজককে বলতে শুনি, ‘বিজ্ঞান যেখানে হার মানে, বিশ্বাস সেগুলোকে উতরে দিতে পারে।’ তাও আবার যেনোতেনো কোনো বিষয়ে নয়, হার্ট অ্যাটাকের মতো মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে। সেবিকার বাবার হার্ট অ্যাটাক জানার পর প্রার্থনার মাধ্যমে যাজকরা তাকে ভালো করে দিতে চায়। তাদের ভাষায়, ‘সবাই যদি তার (সেবিকার বাবার) জন্য প্রার্থনা করে এবং চোখ বন্ধ করে ৩০ মিনিট ধ্যান করে, তাহলেই সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।’ বুনুয়েল যাজকদের মুখ দিয়ে এই কথাগুলো বলিয়ে বিচারের ভার ছেড়ে দিয়েছেন সাধারণের ওপর।

দৃশ্যটিতে বুনুয়েল কেবল যাজকদের দৃষ্টিভঙ্গিই তুলে ধরেননি; উন্মোচন করেছেন তাদের আসল রূপও। প্রার্থনা শেষে সেখানে শুরু হয় একত্রে জুয়া খেলা, ধূমপান, মদ পান। একপর্যায়ে সেই যাজক কামুক দৃষ্টিতে সেবিকার কাঁধে হাত রাখতে যায়। সেবিকার সতর্ক দৃষ্টিতে শঙ্কিত হয়ে যাজক তখন হাত ফিরিয়ে নেয়; এরপর নিজ মনেই কী জানি ভেবে হেসে ওঠে। সেবিকা এবার হাসির কারণ জানতে চাইলে, এক নারীর কথা মনে পড়ায় হাসছে বলে জানায় সে। যার সম্পর্কে যাজকের বক্তব্য, ‘একটা সুন্দর নারী; যে আমার কাছে আসতো ব্যবহার হওয়ার জন্য। ওর স্বামী আবার সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলো।’ আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, সেবিকার বাবার জন্য যাজকরা সেই ঘরে আসার সময় তাদের সঙ্গে থাকে বাক্সের মধ্যে রাখা যিশু খ্রিস্টের মূর্তি। বাক্সের মুখ খোলা রেখে সেখানে মোমবাতি জ্বালিয়ে শুরু হয় প্রার্থনা। এ সময় তাদেরকে যথেষ্ট মার্জিতভাবেই দেখা যায়। কিন্তু প্রার্থনা শেষে তাদের মধ্যে যেমন সেই আগের ভাবটা আর থাকে না, সিগারেটের ধোঁয়া, মদ পান আর তাস খেলায় পরিবেশ বদলে যায়; সঙ্গে সঙ্গে যিশু খ্রিস্টের মূর্তির সেই বাক্সটাও ক্লোজ শটে বন্ধ দেখান বুনুয়েল।

আতঙ্ক, স্বপ্ন ও বাস্তবতা

রাত ১০:৩৩ মিনিট। হেনরির মা তখন ঘুমের ঘোরে। শরীরের অর্ধেক চাদরে ঢেকে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। তার পাশেই বসে সিগারেট ধরান হেনরির বাবা। সিগারেটটা শেষ হয়ে গেলে আলো নিভিয়ে শুয়েও পড়েন তিনি। একটু পরেই পানির পিপাসা লাগলে পুনরায় আলো জ্বালিয়ে গ্লাসে পানি ঢালতে গিয়ে দেখেন, ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ০১:০৩ মিনিট। অথচ ততক্ষণে মাত্র ৫১ সেকেন্ড যাওয়ার কথা। বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে হেনরির বাবাকে। আর দর্শক হিসেবে আমাদের মাথায় আসে আপেক্ষিকতা সংক্রান্ত সূত্রের কথা। যেখানে সময় আসলে সময়ের মতো করে চলে না, পারিপার্শি¦ক পরিস্থিতি নির্ধারণ করে দেয় সময়ের গতি। যে কারণে হয়তো সুখের সময়গুলো দ্রুত চলে যায়, না চাইলেও কষ্টকে মনে হয় দীর্ঘস্থায়ী।

পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে যেহেতু ‘স্বাভাবিকের’ উল্টোটাই ঘটছে, হেনরির বাবার ক্ষেত্রেও হয়তো তাই ঘটতে থাকে। নিজের অসুস্থতার জন্য যিনি আগে থেকেই চিন্তিত; তার ওপর মেয়ে হেনরিকে তাদের ভাষায় ‘পর্নোছবি’ দেওয়ার বিষয়টি তাকে আরো উদ্বিগ্ন করে তোলে। তাছাড়া ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের বাস্তবতায় ফ্রান্সের যে অস্থিরাবস্থা, সেরকম পরিস্থিতিতে কারো পক্ষেই নিশ্চিন্তভাবে আড়াই ঘণ্টা এতো অল্প সময়ে পার করে দেওয়াও সম্ভব নয়। বরং এমন অস্থিরাবস্থা যেকোনো মানুষকে ভাবিয়ে তোলার কথা।

তবে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ৫১ সেকেন্ডে আড়াই ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। ৫১ সেকেন্ডে ইমেজ ব্যবহারে ৫১ বছর পার করে দেওয়াটাই তো মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের ক্ষমতা। কিন্তু সেটা কোনোভাবেই এক শটে দেখানো সম্ভব নয়। অথচ আড়াই ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার এই ঘটনা দেখা যায় এক শটেই। ঘটনার উপস্থাপনে বুনুয়েল যেহেতু পরাবাস্তবতার আশ্রয় নিয়েছেন; চিন্তিত মানুষের ছটফটানিতে তাই সময় স্থবির হওয়ার বিপরীতে দ্রুত পেরিয়ে যায়। উদ্বিগ্ন থাকার কারণেই যে এমন হচ্ছে, সেটা বোঝা যায় এর পরের শটেই। যখন সেই ঘরে একে একে আসতে থাকে মুরগি, ডাকপিয়ন আর উটপাখি। এগুলো হেনরির বাবার অযৌক্তিক মনের স্বপ্ন, গোপন কল্পনা। যার ব্যাখ্যা মেলে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের কাছে।

ফ্রয়েডের মতে, মানুষ সবসময় সুখ চায়। প্রতিনিয়ত যেসব ঘটনার মধ্য দিয়ে সে যায়; তার মধ্যে ঘটে যাওয়া রাগ, ক্ষোভের অনেক কিছুই আপাত সে ভুলে যেতে চায়। অবদমিত এই ক্ষোভগুলো থেকে যায় ব্যক্তির অবচেতন মনে। পরে সেগুলো ফিরে আসে স্বপ্নের মধ্যে কিংবা অন্য কোনোভাবে। যেটা ঘটেছে হেনরির বাবার ক্ষেত্রেও। জাগ্রত অবস্থার বিভিন্ন বিষয়ের চিন্তা হেনরির বাবার স্বপ্নে-চিন্তায় অবচেতনভাবেই চলে আসে মুরগি, উটপাখি আর ডাকপিয়ন হয়ে।

বুনুয়েল চেয়েছিলেন মানুষের অবদমিত কামনা-বাসনা ও ধারণাগুলোকে সব রকমের সামাজিক-রাজনৈতিক আদর্শগত অবদমন থেকে মুক্ত করতে। এজন্য হেনরির বাবার অবদমিত বিষয়গুলোকে তুলে ধরেছেন মুরগি, ডাকপিয়ন আর উটপাখির মাধ্যমে। ঘটনার সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক এই প্রাণীগুলোকে ঘরের মধ্যে নিয়ে এসে দ্বন্দ্ব তৈরি করে দিয়েছেন মানুষের চিন্তায়। তাছাড়া সময়ের ক্ষেত্রেও দ্বান্দ্বিক বৈপরীত্যের মধ্য দিয়ে পুনঃনির্মাণ করতে চেয়েছেন বাস্তবের।

আর রাত তিনটার সময় মোমবাতি হাতে আসা ওই নারী হলো ‘ঘুমদেবী’। যিনি হাতের মোমটা নিভিয়ে দিলে ঘুমিয়ে যান হেনরির বাবা; যে ঘুম থাকে রাত চারটা পর্যন্ত। ডাকপিয়ন আর উটপাখি ‘স্বপ্ন’ হয়ে আসে সেই অল্প সময়ের ঘুমেই। সারাদিন আতঙ্কে কাটিয়ে আসা হেনরির বাবার আতঙ্কটা এবার ফিরে আসে উটপাখি হয়ে। নিজে যেমন অসহায়ভাবে আতঙ্ক বয়ে বেড়ান, উটপাখিরও চোখে-মুখে থাকে কেবল অসহায় চাহনি।

কিন্তু সমস্যা তো তার পরেও থেকেই যায়। স্বপ্নের মধ্যে হলেও এগুলো ঘটতে থাকে বাস্তবের মতো করে। উটপাখি কিংবা ডাকপিয়ন স্বপ্নের মধ্যে না এসে ঘরে ঢুকে পড়ে বাস্তবে। ‘স্বপ্নের’ মধ্যে দেওয়া ডাকপিয়নের সেই চিঠি হাতে তুলে নেন হেনরির বাবা। এমনকি স্বপ্ন শেষে দিন হয়ে গেলেও সেই চিঠিটা থেকে যায় তার হাতে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা তৈরির ক্ষেত্রে বুনুয়েল যেনো ফ্রয়েডের চেয়েও এক পা এগিয়ে। আর এটাই তো বুনুয়েলের সুররিয়ালিজম, ফ্যান্টম তো সেখানেই।

এর শেষ কি নেই

উটপাখির আতঙ্ক আর গুলির শব্দ¾দুটোই চলতে থাকে চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে। ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দের টলিডো শহরের সেই ঘটনার কথাই বলি, আর ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ফ্রান্সের বাস্তবতা কিংবা বর্তমানের কথাও যদি ধরি; তাহলে কোনো সময়ের সঙ্গেই কোনোটার খুব একটা পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। দুর্নীতি দমন, সহিংসতা বন্ধ, ন্যায়বিচার, নিরাপত্তার কথা বললেও রাষ্ট্র কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয় না এগুলো বন্ধের। এর বিপরীতে তারা আইনি সহিংসতা করে। অবশ্য রাষ্ট্র নিজেই একটা ‘অবৈধ’ ধারণা; সহিংসতা নামক ডানার ওপর ভর করে টিকে আছে যার অস্তিত্ব। সেই অনিয়মের মধ্যে নিয়ম খুঁজতে যাওয়াটাই বোকামি!

রাষ্ট্র যতদিন থাকবে, অস্ত্র যতদিন থাকবে, আইন আর আইনের রক্ষকেরা যতদিন থাকবে; এই অনিয়মগুলোও হয়তো টিকে থাকবে। রাষ্ট্রের কর্তারা টিকিয়েও রাখবে। সহিংসতা যদি বন্ধই হয়ে যায়, তাহলে তো আর আইনের প্রয়োজন পড়ে না। আর আইনের প্রয়োজন না পড়লে প্রয়োজন হবে না অন্য অনেক কিছুরই, টান পড়বে রাষ্ট্রের অস্তিত্বেও। সে কারণেই কেবল সহিংসতা বন্ধের কথা শোনা যায়, কোনোকিছুই আর বন্ধ হয় না। বুনুয়েলের চলচ্চিত্রেও তাই শেষ দৃশ্যেও শেষ হয় না উটপাখির আতঙ্ক। একের পর এক শোনা যায় গুলির শব্দ, বিদ্রোহীদের আর্তনাদ।

বর্তমানের এই পরিস্থিতিও কি তাহলে চলতে থাকবে সেই একই সূত্রে?

লেখক : কাওসার বকুল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী

bokulmcj71@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. দাশগুপ্ত, ধীমান (২০০৬ : ৪৯৩); ‘সাররিয়ালিজম/সুররিয়ালিজম’; চলচ্চিত্রের অভিধান; বাণীশিল্প, কলকাতা।

২. ‘গোপন তথ্য প্রকাশে সম্মতি আমেরিকার’; এই সময়, ০১ আগস্ট ২০১৩।

৩. বিবিসি বাংলার ২৭ মার্চ ২০১৫, শুক্রবারের সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সংবাদমূলক অনুষ্ঠান ‘প্রবাহ’ থেকে নেওয়া।

৪. ‘অজ্ঞাত আসামি ও ৫৪ ধারার কাছে অসহায় সাধারণ মানুষ’; প্রথম আলো, ২৩ মার্চ ২০১৫।

৫. ‘কঠিন ব্যবস্থা নিন, দায়িত্ব আমি নেব’; প্রথম আলো, ২৯ জানুয়ারি ২০১৫।

৬. ‘গুলিবিদ্ধ ১৫-র ৯ জনই অরাজনৈতিক ব্যক্তি’; প্রথম আলো, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫।

৭. ‘নাশকতার আগুনে প্রাণ গেলো আরো ৪ জনের’; প্রথম আলো, ২৩ মার্চ ২০১৫।



বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।



এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন